কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য। বাংলাদেশের কৃষি। বাংলাদেশে কৃষির গুরুত্ব কেমন?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষি অর্থনীতি অনেকগুলো পৃথক জ্ঞানের একটি সমন্বিত শাখা। সাধারণ অর্থে কৃষি বলতে ভূমি কর্ষন করে ফসল ফলানোকে বোঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে কৃষি শব্দটি আরো ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত করা হয়ে থাকে। অর্থনীতিতে পশুপালন থেকে শুরু করে শস্য উৎপাদন, বনায়ন, খনিজ এবং মৎস সম্পদ আহরণ প্রভূতি সকল প্রকার প্রাকৃতি সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়াকে কৃষির অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি দেশের অর্থনীতির একটি অপরিহার্য উপাদান।
বাংলাদেশের কৃষি
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান কর্মকান্ড এবং চালিকাশক্তি। উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির ভূমিকা রয়েছে। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাত তাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শ্রম শক্তির প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থান যোগান দেয় এবং কৃষি ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া কৃষি বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় ভোক্তাদের চাহিদাভিত্তিক মালামালের উৎস। তাই বাংলাদেশের কৃষিখাত যুগ যুগ ধরে মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
আমাদের দেশের কৃষক
কৃষক একজন ব্যক্তিবিশেষ যিনি কৃষিকার্য পেশায় নিয়োজিত থেকে ফসল উৎপাদন করেন। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষক হলো সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। যে কৃষক আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলায় তাদেরকে আমরা চাষা-ভূষা বলে অবজ্ঞা করে থাকি। অথচ সেই কৃষকের কষ্টের অর্জিত ফসল আমরা সারা-বছর খেয়ে থাকি। একজন কৃষক তার নিজের জমিতে অথবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কিংবা অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে থাকেন। একজন কৃষক অনেক কষ্ট করে থাকেন। তিনি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে চলে যান। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করে থাকে।
বেশির ভাগ কৃষক এখনো ফসল উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে লাঙ্গল, মই এবং গরু ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। তারা বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে থাকেন। তন্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ধান, গম, ভট্টা, আঁখ, বিভিন্ন ধরণের সবজি প্রভূতি চাষ করে থাকেন। তারা যে পরিমাণে কষ্ট করে থাকেন তার অর্ধেক পারিশ্রমিক পায় না। তাদেরকে সমাজের চোখে ছোট করে দেখা হয়। মোট কথায় আমাদের দেশের কৃষক অবহেলিত হয়ে থাকেন। এতে সুবিধা ভোগ করছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দাম পণ্য কিনে মজুত করে রাখছেন এবং দেশের অবস্থা বুঝে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে থাকেন। দেশে কৃষি খাতের উন্নয়ন হলেও কৃষকের উন্নয়ন হয় নি।
বাংলাদেশের কৃষি কাঠামো | কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবস্থান ও গুরুত্ব, উৎপাদনের উদ্দেশ্য, ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা, খামারের আয়তন, উৎপাদন ব্যবস্থা, কৃষির বিভিন্ন উপখাতের তুলনামূলক গুরুত্ব ইত্যাদি দিয়ে গঠিত কৃষি খাতের সার্বিক অবস্থাকে কৃষি কাঠামো বুঝায়। বাংলাদেশের কৃষি কাঠামোকে এখনো সার্বিকভাবে সনাতন কৃষি বলা হয়। এখানে ব্যবসায় হিসেবে মুনাফার উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষিকে এখনো গ্রহণ করা হয় নি। প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ এবং অর্থনীতির উন্নয়ন স্তব কৃষি কাঠামোকে প্রভাবিত করে বলে দেশেভেদে এর প্রকৃতি ভিন্ন হয়।
১। ভূমি কর্ষণ
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক নিজের জমি চাষাবাদ করে থাকেন। এ ধরনের মালিক চাষীর দ্বারা আমাদের মোট আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ কর্ষিত হয়। এছাড়া আছে বর্গাচাষী যারা নির্দিষ্ট শর্তে অন্যের জমি চাষ করে। বাংলাদেশের ২০ শতাংশ আবাদি জমি বর্গা চাষের অধীনে রয়েছে। আবার অনেক সময় ঋণের প্রয়োজনে জমির মালিক জমি বন্ধক দিয়ে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। এরূপ ক্ষেত্রে ঋণদাতা ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত জমি চাষাবাদ করতে থাকে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষক একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পূর্ব নির্ধারিত অর্থ কিংবা ফসলের বিনিময়ে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করেন।
২। চাষ পদ্ধতি
আমাদের দেশে এখনও পুরাতন চাষাবাদ পদ্ধতির প্রাধান্য রয়েছে। আমাদের দেশের কৃষকেরা এখনও লাঙল গরুর সাহায্যে জমি চাষ করে থাকেন। উন্নত জাতের বীজ এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার অনেক কম। তবে বর্তমানে উচ্চ ফলনশীল বীজ প্রচলিত হওয়ায় আমাদের কৃষির আধুনিকরণের যাত্রা শুরু হয়েছে।
৩। কৃষি পণ্যের ধরণ
বাংলাদেশের কৃষিতে দু ধরনের ফসল উৎপাদিত হয়। (ক) খাদ্য শস্য এবং (খ) অর্থকরী ফসল। ধান, গম, ভূট্টা, ডাল, তৈলবীজ, শাক-সবজি, ফলমূল প্রধান খাদ্যশস্য। অপরদিকে অর্থকরী ফসলের মধ্যে রয়েছে পাট, রেশম, তুলা ইত্যাদি। তাছাড়া কৃষক তার বাড়িতে গরু, মহিষ, হাঁস-মুরগি পালন করে। তবে বানিজ্যিক ভাবে পশু পালন ও হাঁস-মুরগির খামারের সংখ্যা এখনও খুবই কম। সঠিকভাবে পশু পালন ও হাঁস মুরগির খামার গড়ে তুলতে পারলে আমরা নিজে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে উন্নতি ঘটবে।
৪। খামার ব্যবস্থা
বাংলাদেশে জীবন ধারণ উপযোগী খামার ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। খামার বলতে এমন একটি স্থাপনাকে বুঝানো হয় যেখানে কৃত্রিম ভাবে যেকোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সাধন করা হয়। সাধারণত গবাদি পশু এবং কিছু বাণিজ্যিক উদ্ভিদ ও প্রাণী এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদন ও বিপণন করা হয়। জীবন ধারণ উপযোগী খামারে পরিবারে ভরণ-পোষণের জন্য যে বিভিন্ন ফসলের প্রয়োজন হয় সম্ভব হয়ে তা প্রায় সকলই একই খামারে উৎপাদন করার চেষ্টা করা হয়। এদেশে এখনও বানিজ্যিক খামার ব্যবস্থা প্রসার লাভ করে করে নাই।
৫। কৃষির উপখাত
পূর্বে কৃষির বিভিন্ন উপখাত হিসেবে শস্য বা ফসল, মৎস্য, পশু ওবনজসম্পদকে বিবেচনা করা হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষির উপখাত চারটি। আর তা হলো শস্য ও শাকসবজি, প্রাণী সম্পদ এবং বনজ সম্পদ। মৎস্য সম্পদ বর্তমানে উন্নত কৃষি খাত।
৬। বীজ উৎপাদন
বীজ কৃষির ভিত্তি। বীজ বীজন্ত এবং প্রয়োজনীয় সব উপাদান দ্বারা এমন অনুপমভাবে সুসজ্জিত যে সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে নতুন বংশধরের সূচনা করতে পারে। এ জীবন্ত বস্তুটিকে পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেসব কাজ ও কৌশল অবলম্বন করতে হয় সেগুলোকেই বীজ সংরক্ষণ বলে। বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন সারা দেশে ২৪ টি দানা শস্য বীজ উৎপাদন খামার, ২ টি পাট বীজ উৎপাদন খামার, ২ টি আলু বীজ উৎপাদন খামার, ৩ টি ডাল ও তৈল বীজ উৎপাদন খামার, ২ টি সবজি বীজ উৎপাদন খামার এবং ৭৩ টি চুক্তিবদ্ধ চাষি জোনের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
FAQS-
# বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য কি?
=>বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য হল ধান।
# ধান উৎপাদনে পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান কততম?
=>ধান উৎপাদনে পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
# ধান উৎপাদনে শীর্ষদেশ কোনটি?
=>ধান উৎপাদনে শীর্ষদেশ চীন।
# বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল কোনটি?
=>পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসল সারা বিশ্বে তুলার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আঁশ ফসল হিসাবে পরিচিত এবং বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল।
# বাংলাদেশে কৃষির অবদান কত শতাংশ?
=>বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, এটি দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ যোগান দিয়ে থাকে এবং দেশের মোট জিডিপিতে এর অবদান ১৪.১০ শতাংশ।
#বাংলাদেশ কি কৃষিপ্রধান দেশ?
=>বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। আমাদের আবহমান বাংলার গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্য মিশে আছে কৃষির সঙ্গে। মূলত বাঙালি জাতির শেকড় নিহিত রয়েছে কৃষির মধ্যে।
শেষ কথা
বর্তমান সরকারের কৃষিক্ষেত্রে গৃহীত উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে আজ কৃষির প্রত্যেকটি খাতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রত্যেকটি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হওয়ায় এখন এ দেশের কৃষক কেবল খাদ্য নিরাপত্তা নয় বরং পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে দেশ ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জমি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে জনমানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকার নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার সত্যিকার অর্থেই খাদ্য ঘাটতির দেশকে এক খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত করার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
[…] কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য। বাংলাদেশে… […]