কিভাবে গরু পালন করতে হয়? আধুনিক পদ্ধতিতে গরু পালন!
সভ্যতার শুরু থেকেই পৃথিবীতে জন্তু জানোয়ার এবং মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়েই বেঁচে আছেন। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভরশীল দেশ। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ সেক্টরটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আদিকাল থেকেই এদেশের মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার তাগিদে গবাদিপশু লালন-পালন করে আসতেছে।
সাধারণত গবাদিপশু বলতে গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশুকেই বোঝায়। গবাদিপশু থেকে আমরা দুধ এবং মাংস পাই। এছাড়া জমি চাষ, ফসল মাড়াই, পরিবহন, গোবর সার এবং জ্বালানিতে গবাদিপশুর ভূমিকা অপরিসীম। দরিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গবাদিপশু অন্যতম হাতিয়ার। সুতরাং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গবাদিপশুর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আধুনিক পদ্ধতিতে গরু পালনের উপায়
গরু গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত প্রাণী। গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে কম-বেশি এই প্রাণীটি রয়েছে। সবাই এই প্রাণীটি লালন-পালন করে থাকেন। আধুনিক পদ্ধতিতে গরু পালন করার কিছু উপায় রয়েছে। আবদ্ধ ঘর হলে গরুকে এক সারি বা দুই সারিতে পালন করা যায়। দুই সারি বিশিষ্ট ঘরে গরুকে অন্তর্মূখী বা বহির্মূখী পদ্ধতিতে গাভী পালন করা হয়।
প্রতিটি গাভীর জন্য গড়ে ৩৫-৪০ বর্গ ফুট (৮’*৫’) জায়গার প্রয়োজন হয়। এভাবে আপনি ১০ টি গরু পালন করলে এই হিসাব করে জায়গা প্রয়োজন হবে। আবার ঘরের মেঝে থেকে চালার উচ্চতা কমপক্ষে ১০ ফুট হতে হবে। যাতে বড় গরু পালন করলে সমস্যা না হয়। টিনের চালা বিশিষ্ট ঘর হলে টিনের চালার নিচে চাটাই ব্যবহার করতে হবে। যাতে রোদের তাপমাত্রা সরাসরি গরুর গায়ে না লাগে।
গোয়াল ঘরে খাদ্য সরবরাহের জন্য ৫ ফুট প্রশস্ত রাস্তা, খাদ্য পাত্র ও পানির পাত্রের জন্য ২ ফুট এবং নালার জন্য ১ ফুট জায়গা রাখতে হবে। গোয়াল ঘরের বর্জ নিষ্কাষনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ রাখতে হবে। গোয়াল পাকা হলে মসৃণ প্লাষ্টার না করে খসখসে রাখতে হবে যাতে গরু পিছলিয়ে পড়ে না যায়। গরুর খাবারের জন্য আপনি গোয়াল ঘরে ব্যবস্থা করতে পারেন অথবা বাইরেও খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন। আদর্শ খামারীরা গরুর খাবারের ব্যবস্থা ঘরেই করে থাকেন।
গরু পালন শুরু করার পূর্বে যে বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন
গরু পালন শুরু করতে হলে আপনাকে অবশ্যই গরু পালন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামে ব্যাপকহারে গরু পালন করা হয়ে থাকে। গরু পালন করার মাধ্যমে অনেকেই আবার স্বাবলম্বী হয়েছেন। তবে গরু পালন করার পূর্বে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত।
১। খামার শুরু করার আগে আপনাকে ৩-৬ মাস মেয়াদী যুব উন্নয়ন বা প্রাণীসেবা হাসপাতালে সাপ্তাহিক ও মাসিক ট্রেনিং গুলোতে যোগ দিতে হবে।
২। গরুর যত্নে সঠিক সময়ে খাদ্য দেওয়া জরুরী। গরুকে যে খাদ্য খাওয়াতে হবে দিনে ২ বেলা কাঁচা ঘাস, খড়, দানাদার, পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানি। এছাড়াও গরুকে মোটা-তাজা করার নিজে খাদ্য তৈরী করতে হবে।
৩। পরিচিত কোনো খামারে কিছু দিন সময় দিন এবং তার কাজকর্মগুলো ভালো করে খেয়াল করুন। তিনি গরুকে কোন সময়ে খাদ্য দেয়, গোসল করায় এবং খামার পরিস্কার করেন। ডাক্তারের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন এবং জেনে নিন কোন কোন রোগে কি কি চিকিৎসা দিতে হয়।
৪। গরুকে ঔষুধ খাওয়ানোর নিয়ম জানতে হবে। কারণ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গরুর শ্বাসনালীতে ঔষুধ গেলে গরু মারা যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। গরুকে ঔষুধ খাওয়ার সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হলো খাদ্যের সাথে বা পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো।
৫। খামারে গরুর সাধারণত যে রোগ গুলো বেশি হয়ে থাকে তা জানতে এবং সমাধানের উপায় জানতে হবে। খামারে গরু অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু দিন পর পর গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
গরু পালনে গুরুত্ব
আদিকাল থেকেই গবাদি পশু মানুষের কল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে কৃষি, শিল্প, খাদ্য উৎপাদন ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গবাদিপশু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গাভীর দুধ খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাদ্য যা শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজন। উৎপাদিত দুধ বিক্রি করে দৈনিক নগদ অর্থ উপার্জন করা যায়। এছাড়াও দুধ দিয়ে ঘি, মাখন, মিষ্টি, দই , ছানা, বোরহানি, ক্ষীরসা, চকলেট সহ আরো অনেক ধরনের সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করা হয়ে থাকে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে চামড়া এবং সার ও জ্বালানীর জন্য গোবর অন্তর্ভুক্ত। আবার হিন্দুধর্মে ধর্মীয় কারণে গরুকে অনেক গুরুত্ব এবং মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে।
কৃষিকাজে গরুর ভূমিকা
সেই প্রাচীন কাল থেকে মানুষের কৃষিকাজে গরু এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসতেছে। কৃষি এবং গবাদিপশু একই সূত্রে গাঁথা। গরুকে ব্যবহার করেই আমরা জমিতে লাঙ্গল এর সাহায্যে চাষাবাদ করে ফসল ফলাই। সেই ফসল আমাদের জীবনধারণের অন্ন জোগায়। মাঠে ফসল উৎপাদন ছাড়াও কৃষির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ধরণের কাজ যেমন ফসল মাড়াই ও ঘানি টানা প্রভূতি কাজেও গরুকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি
বাংলাদেশের দারিদ্র দূরীকরণের জন্য সর্বোত্তম শিল্প হিসেবে গবাদিপশুকে বিবেচনা করা যেতে পারে। অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায় শিল্প, কৃষি ও ব্যবসা সম্প্রসারণে পশুসম্পদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখে ব্যক্তি ও জাতির আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। উন্নত দেশগুলোতে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে গরু পালন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক সহায়তা করছে। আমাদের দেশের জন্যও গবাদিপশু একটি বিরাট সম্পদ। এই সম্পদ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে পারলে দেশের দারিদ্র দূরীকরণে এবং আত্মকর্মসংস্থানে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারবে। অনেক বেকার যুবক এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে এক দিকে যেমন বেকারত্ব দূর হলো অপরদিকে সে নিজেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠলো। অবশ্য ইতোমধ্যেই গরু পালন করে অনেক কৃষকই হয়েছে। তাই আপনি আজই এই উদ্যোগ গ্রহণ করুন।
FAQS-
# গরু কিভাবে পালন করতে হয়?
=>সাধারণত গরু সবাই পালন করে থাকেন। আপনারা খেয়াল করে দেখবেন এক জনের গরু আরেক জনের গরু থেকে আলাদা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরু সংগ্রহ করার দেড় থেকে দুই মাস পরে উন্নত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করার কথা।
# আধুনিক গরু পালন কি?
=>আবদ্ধ ঘরে গরু এক সারি বা দুই সারিতে পালন করা যায়। আধুনিক গরু পালন বলতে প্রতি গাভীর জন্য জায়গা, ঘরের চালার উচ্চতা, গাভীর খাওয়া-দাওয়া এবং উপযুক্ত পরিবেশ প্রভূতি সমষ্টিকে বোঝায়।
# গরুকে কিভাবে খাবার পানি দিতে হয়?
=>গরুকে সবসময় টাটকা ও পরিষ্কার খাদ্য ও পানি দিতে হবে। প্রতিদিন একই সময়ে খাবার ও পানি দিতে হবে। নিয়মিত ওজন গ্রহণ এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওজন নির্ণণয় করে মাংস বৃদ্ধির হার পরীক্ষা করতে হবে।
শেষ কথা
মানবজীবনে মানুষের জীবনে গরু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষের মানুষ তাই এই প্রাণীটিকে নিজের মায়ের মতো শ্রদ্ধা করে থাকেন। গ্রামের মানুষেরা নিজেদের পালিত গরুকে পরিবারের থেকে আলাদা করে দেখতে পারেন না। তারা এই প্রাণীটিকে খুব আদর যত্ন করে থাকেন। এই প্রাণীটিও তার সারা জীবনের দানে মানুষকে পূর্ণ করে দেয়। গৃহপালিত পশু হিসেবে গরু এবং মানুষের ভালোবাসার সম্পর্কপৃথিবীর বুকে এভাবেই আবর্তিত হতে থাকে। তাই গৃহপালিত গবাদিপশু গরুকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
# কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য। বাংলাদেশের কৃষি। বাংলাদেশে কৃষির গুরুত্ব কেমন? # গরু