কিভাবে ছাগল পালন করতে হয়? ছাগল পালন পদ্ধতি
ছাগল বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিসম্পদ। ছাগল আমাদের দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ও দারিদ্র্য হ্রাস, মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ছাগল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য, এদেশের মোট প্রায় দু’ কোটি পঞ্চাশ হাজার ছাগলের অধিকাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের। ছাগল পালনে স্বল্প পুঁজি, স্বল্প জায়গা এবং কম খাদ্য খরচের প্রয়োজন হয়। আত্মকর্মসংস্থান, বেকার সমস্যা হ্রাস, দারিদ্র বিমোচন, পুষ্টি সরবরাহ সর্বোপরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ছাগল হতে পারে একটি অন্যতম হাতিয়ার।
যেভাবে ছাগল পালন করবেন
ছাগলকে সাধারণত গরীরের গাভী বলে উপাধি দেয়া হয়ে থাকে। কম পূঁজির ব্যবসার মধ্যে এটি অধিক লাভজনক একটি ব্যবসা। বর্তমানে প্রচুর মানুষ পারিবারিক খামারে বা গৃহস্থালীতে ছাগল পালনের মাধ্যমে দুধ এবং মাংশের চাহিদা পূরণ করছেন। এছাড়াও ছাগলের দুধ, মাংশ, পনির বিক্রি করেও অর্থ উপার্জন করছেন। গৃহপালিত প্রাণীর মধ্যে ছাগল অন্যতম।
ছাগল পালনের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ছাগলের প্রজাতি নির্বাচন, ছাগল ক্রয়, আবাসস্থল নির্বাচন থেকে শুরু করে আরও বেশ কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। আর আপনি সেগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করলে হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল উদ্যোক্তা। সাধারণত ছাগল চার ভাবে পালন করা হয়ে থাকে। নিচে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
(ক) নিবিড় পদ্ধতিতে ছাগল পালন
এই জাতীয় খামারে আবদ্ধ অবস্থায় ছাগল পালন করা হয়। তাই খামারের সেড ও ব্যবস্থাপনার সুযোগ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক ছাগল পালন করা হয়। বানিজ্যিক ভিত্তিতে পালন করা হয় বিধায় ছাগলের পুষ্টি প্রজনন ও স্বাস্থ্য বিষয়ে যথাযথ যত্ন নেয়া সম্ভব। এজন্য কাঙ্গিত উৎপাদন আশা করা যায়। অল্প জায়গায় অধিক পরিমানে ছাগল পালন করা যায় এবং প্রাপ্ত বিভিন্ন উপজাতস মূহের সুষ্ঠ ব্যবহার করা যায়।
(খ) মুক্তভাবে ছাগল পালন
সাধারণত এ পদ্ধতিতে ছাগল পালনে বাসস্থানে বাড়তি কোন ঘাস সরবরাহ করা হয় না। তাই এ পদ্ধতিতে ছাগল পালন করতে আলাদা করে ঘাস চাষের প্রয়োজন হয় না। পাহাড় বা চর এলাকায় মুক্তভাবে ছাগল চরানোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে এবং ছাগলের রোগ-বালাই তুলনামুলক কম হয়ে থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চর এলাকা ছাড়া দেশের অধিকাংশ স্থানেই এ পদ্ধতিতে ছাগল পালন করা প্রায় অসম্ভব।
(গ) পারিবারিকভাবে ছাগল পালন
আমাদের দেশে বেশীরভাগ কৃষক এ পদ্ধতিতে ছাগল মাঠে ছেড়ে দিয়ে বা বেঁধে ঘাস খাওয়ান। তবে মাঠে ছেড়ে ছাগল পালন করলে অনেক ক্ষেত্রে ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। পারিবারিকভাবে ছাগল পালনের জন্য ২-৫ টি ছাগল রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে ছাগল পালন সহজ এবং খরচ নাই বললেই চলে। পারিবারিকভাবে ছাগল পালন করতে বাড়তি কোনো লোকের প্রয়োজন হয় না। তাই আপনি এই পদ্ধতিতে ছাগল পালন করতে পারেন।
(ঘ) আধা-নিবিড় পদ্ধতি
আধা-নিবিড় খামারে ছাগলকে দিনে চড়ানো হয় এবং রাতে তাদের আবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের জন্য ঘাস ও দানাদার খাদ্য সম্পূরক হিসেবে সরবরাহ করা হয়। বানিজ্যিক বিত্তিতে পালন করা হয় বিধায় ছাগলের পুষ্টি, প্রজনন, স্বাস্থ্য বিষয়ে যথাযথ যত্ন নেয়া সম্ভব। ফলে এ পদ্ধতিতে ছাগলের উৎপাদন অনেকটা আশানুরূপ হয়। বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বাণিজ্যিকভাবে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী। তবে এক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ ও বিনিয়োগ তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই বেশী।
প্রচলিত পদ্ধতিতে ছাগল পালন
গ্রামে ছাগলকে মাঠে, বাগানে, রাস্তার পাশে বেঁধে বা ছেড়ে দিয়ে পালন করা হয়।সাধারণত ছাগলকে বাড়ি থেকে কোনো বাড়তি খাদ্য সরবরাহ করা হয় না। কৃষক বর্ষাকালে বিভিন্ন গাছের পাতা কেটে ছাগলকে খেতে দেয়। রাতে ছাগলকে নিজেদের থাকার ঘর বা অন্য কোনো ঘরে আশ্রয় দেয়।বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ছাগল পালনের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এতে ছাগলের বাসস্থান, খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বৈজ্ঞানিক উপায়ে আবদ্ধ ও অর্ধ-আবদ্ধ পদ্ধতিতে ছাগল পালন করা হয়। যাদের চারণ ভূমি বা বাঁধার জন্য কোনো জমি নেই সেখানে আবদ্ধ পদ্ধতিতে ছাগল চাষ করা হয়। তবে প্রতিদিন কয়েক ঘন্টার জন্য ঘরের বাইরে ঘুরিয়ে নিয়ে এলে এদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। নতুন ছাগল দিয়ে খামার শুরু করলে প্রথমেই সম্পূর্ণ আবদ্ধ অবস্থায় রাখা যাবে না।
দারিদ্র বিমোচনে ছাগল পালন
ছাগল বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ পশুসম্পদ। ছাগল আমাদের দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ও দারিদ্র্য হ্রাস মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ছাগল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।বাংলাদেশের শতকরা ৭০টি পরিবার বিশেষ করে দরিদ্র পরিবার ছাগল পালন করে কিছু নগদ অর্থ আয় করে। এই জন্য ছাগল গরিবের গাভী হিসাবে সমাধিক পরিচিত। ছাগলের দুধ রোগীর পথ্য হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বেকার যুবক, মহিলা, প্রান্তিক/ভূমিহীন পরিবার ও ক্ষুদ্র খামারীদের আত্মকর্ম সংস্থান এবং আমিষের চাহিদা পূরণে ছাগল পালন খুবই সহায়ক।
ছাগলের জাত কত প্রকার
পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ রকমের ছাগলের জাত আছে। কিন্তু আকার, আয়তন এবং বৈশিষ্ট্য ভেদে এরা একে অপরের থেকে আলাদা হয়। বিভিন্ন দেশ ও স্থানভেদে বিভিন্ন জাতের ছাগল পালন করে থাকে। যেমন সানেন ব্লাক বেঙ্গল, টোগেন বার্গ, বারবারি ও যমুনাপারি। কিছু ডেইরি জাতের ছাগল কিছু মাংস এবং দুধের জন্য পালন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যে যমুনাপারি ছাগল পালন সবচেয়ে উত্তম।
যমুনাপারি ছাগলটি যমুনা নদীর নাম থেকে নামকরণ করা হয়েছে। এটা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রজাতির ছাগল। এই ছাগল সর্বপ্রথম ১৯৫৩ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানী করে করে এবং পরে দেশীয় জাতের সাথে শংকরায়ন করা হয়। পরে এই ছাগল পেরাকান এতাঁওয়া নামে পরিচিতি পায়। ২০১৮ সালে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জেনোম সিকোয়েন্সিং বা পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করেছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের একটি দল।
ছাগলের খাবার
ছাগল পালনের জন্য খাদ্যের সঠিক নির্বাচনই হচ্ছে অন্যতম প্রধান বিষয়। সাধারণত ছাগলের প্রধান মূল খাদ্য হলো সবুজ ঘাস ও দানাদার খাদ্য। ছাগল সাধারণত তার ওজনের ৪-৫% হারে খেয়ে থাকে। এরমধ্যে ৬০-৮০% আঁশ জাতীয় খাবার এবং ২০-৪০% দানাদার খাবার দিতে হবে।
দুই বাচ্চা বিশিষ্ট ২৫ কেজি ওজনের ছাগীর দৈনিক প্রায় ১.৫-২.৫ কেজি কাঁচা ঘাস এবং ৩৫০-৪৫০ গ্রাম দানাদার খাদ্য প্রয়োজন হয়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক পাঁঠার দৈনিক ১.৫-২.৫ কেজি কাঁচা ঘাস এবং ২০০-৩০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য প্রয়োজন। এসব খেয়েই ছাগল জীবন ধারণ করে থাকে। এছাড়াও চিকন ধানের খড় খুব ছোট ছোট করে কেটে তার সাথে চিটাগুড় মিশিয়েও ছাগলকে খাওয়ানো হয়।
সুস্থ ছাগলের বৈশিষ্ট্য
ছাগল পালন করলে ছাগলের সুস্থতা সম্পর্কে জানা খুব জরুরী। কারণ ছাগল সুস্থ না অসুস্থ তা জানতে না পারলে আপনার লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। সুস্থ ছাগলের নাড়ীর স্পন্দন প্রতি মিনিটে ৭০-৯০ বার, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতি মিনিটে ২৫-৪০ বার এবং তাপমাত্রা ৩৯.৫ সেঃ হওয়া উচিত। সুস্থ ছাগল দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে, মাথা সবসময় উঁচু থাকে, নাসারন্ধ থাকবে পরিষ্কার, চামড়া নরম, পশম মসৃন ও চকচকে দেখাবে এবং পায়ু অঞ্চল থাকবে পরিচ্ছন্ন। তাই এই বিষয়গুলোর উপর বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ছাগল পালনের সুবিধা সমূহ
ছাগল পালনের সুবিধা অনেক। ছাগল পালন করে অনেকে লাভবান এবং স্বাবলম্বী হচ্ছে। নিচে ছাগল পালনের সুবিধা সমূহ আলোচনা করা হলো-
- অল্প পুঁজি এবং অল্প জায়গাতে খুব সহজেই ছাগল পালন করা যায়।
- অন্যান্য পশুর তুলনায় রোগবালাই কম হয়।
- দুধ, মাংশ, চামড়ার ব্যাপক চাহিদা।
- ছাগল ছোট প্রাণী হওয়ায় ছোট ছেলে মেয়েরাও খুব সহজেই পালন করতে পারেন।
- ছাগলের মাংশ পুষ্টিকর ও সুস্বাদু এবং বাণিজ্যিকভাবে অধিক লাভজনক।
- তুলনামূলক কম সময়ে অধিক সংখ্যক বাচ্চা পাওয়া যায়। বছরে দুইবার বাচ্চা প্রসব করে এবং প্রতিবারে গড়ে ২-৩ টি বাচ্চা হয়ে থাকে।
- ছাগল ভূমিহীন ক্ষুদ্র ও মাঝারী চাষীদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়।
FAQS-
# সাধারণত ছাগলের কি কি রোগ হয়?
=>ছাগলের সাধারণত নিউমোনিয়া, একযাইমা, চর্মরোগ, পাতলা পায়খানা, পরজীবি এবং খাদ্যে বিষক্রিয়া দেখা দেয়।
# দেশীয় ছাগল সাধারণত সর্বোচ্চ কতটি বাচ্চা দিতে পারে?
=>দেশীয় ছাগল ৫-৬ টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে।
# ছাগল পালনের উপকারিতা কি কি?
=>ছাগল পালন করলে মাংশ ও চামড়া উৎপাদন, পারিবারিক আয় বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন সামগ্রীতে ব্যবহার এবং দারিদ্র বিমোচনের জন্য ছাগল পালন করা হয়।
# দেশী ছাগল কতটুকু দুধ দিয়ে থাকে?
=>দেশী ছাগল সর্বোচ্চ ১.৫ কেজি দুধ দিয়ে থাকে।
# ছাগলকে সরাসরি চিটাগুড় খাওয়ানো যাবে কি?
=> ছাগলকে সরাসরি চিটাগুড় খাওয়ানো যাবে না। কারণ পাতলা পায়খানা বা বিষক্রিয়া দেখা দিবে।
# ছাগল কিভাবে পালন করতে হয়?
=> ছাগল হল রুমিন্যান্ট যার জন্য উচ্চ মানের রুগেজ প্রয়োজন। যেমন ঘাস বা খড়, মিঠা পানি এবং খনিজ। তাদের সঠিকভাবে খাওয়ানো তাদের স্বাস্থ্যকর হতে সাহায্য করবে এবং তাদের দুধ উৎপাদন উন্নত করবে । ছাগল পালনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সঠিক আবাসন।
শেষ কথা
আমাদের দেশে অন্যতম গৃহপালিত পশু হলো ছাগল। ছাগলের মাংশ খেতে খুবই সুস্বাদু। এই ছাগল পালন করে খামারি একদিকে যেমন তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় তেমনি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তাই আমাদের সবার উচিত ছাগল পালনে উদ্বুদ্ধ হওয়া।
# কিভাবে গরু পালন করতে হয়? আধুনিক পদ্ধতিতে গরু পালন! # কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য। বাংলাদেশের কৃষি। বাংলাদেশে কৃষির গুরুত্ব কেমন?