কিভাবে দিনাজপুর ভ্রমণ করবেন? দিনাজপুর জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ।
দিনাজপুরের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যমন্ডিত দিনাজপুর জেলা চাল, লিচু, টমেটো ও আম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও দিনাজপুরে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে রয়েছে কান্তজীর মন্দির, রামসাগর দীঘি, রাজবাড়ী, লিচু বাগান, সিটি পার্ক, স্বপ্নপুরী স্পট ইত্যাদি। আত্রাই, কাঁকড়া, করতোয়া ও ইছামতি নদীর আববাহিকায় পশ্চিম বাংলার সীমান্ত ঘেসা প্রচিীন শহর দিনাজপুর।
দিনাজপুর ভ্রমণ
উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন জনপদ দিনাজপুর। ঐতিহাসিকদের মতে দিনাজপুর রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ এর নামানুসারে এ জনপদের নামকরণ করা হয়। তার নামানুসারেই রাজবাড়িতে অবস্থিত মৌজার নাম হয় দিনাজপুর। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসকরা ঘোড়াঘাট সরকার বাতিল করে নতুন জেলা গঠন করে এবং রাজার সম্মানে জেলার নামকরণ করে “দিনাজপুর”।
দিনাজপুর ভ্রমণ করার জন্য আপনাকে অনেক সময় নিয়ে আসতে হবে। দিনাজপুরে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দিনাজপুরে পাঁচটি সাগর (রামসাগর, মাতাসাগর, সুখসাগর, আনন্দসাগর ও জুলুম সাগর)। এছাড়া দিনাজপুরে সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হলো কান্দজির মন্দির ও স্বপ্নপূরী। নিচে দিনাজপুর জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো-
রামসাগর
ঐতিহাসিকদের মতে, দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ পলাশীর যুদ্ধের আগে এই রামসাগর দিঘি খনন করেছিলেন। তারই নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় রামসাগর। রামসাগর দিনাজপুর জেলার তেজপুর গ্রামে অবস্থিত মানবসৃষ্ট একটি দিঘি। প্রায় ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯২ বর্গমিটার ক্ষেত্রফল এবং ১০ মিটার গভীরতার এই দিঘির আশেপাশে বিকেলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য দারুণ জায়গা। এই রামসাগরে সাঁতার কাটার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খুব সহজেই মানুষ এখানে ভ্রমণ করে থাকেন। দিনাজপুর শহর থেকে অটোরিকশায় ৩০-৪০ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যায় রামসাগরে।
কান্দজির মন্দির
বাংলাদেশের এই বিখ্যাত স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছিল ১৮ শতকে। অনেক অজানা কাহিনী লুকানো রয়েছে দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের কান্তজীউ মন্দিরটির পেছনে। দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কাহারোল থানার অন্তর্গত কান্তনগর গ্রাম ঢেপা নদীর তীরে কান্তজিউ মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরটিকে কান্তজীউ বা কান্তজির আবার কান্তনগর মন্দির নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
এছাড়াও নবরত্ন মন্দির নামেও এটা অনেকের কাছে পরিচিত। কারণ তিন তলা বিশিষ্ট মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিল। মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার দত্তক পুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। দৈনন্দিন পূজা-অর্চনার পাশাপাশি মন্দিরকে ঘিরে একটি বিশেষ মেলা ও উৎসব আয়োজন করা হয়।
স্বপ্নপূরী পিকনিক স্পট
দিনাজপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটির অবস্থান এর ফুলবাড়ী উপজেলার আফতাবগঞ্জে। প্রায় ৪০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এই সুন্দর নকশাকৃত বিনোদন পার্কটি। ইতিহাস কুশদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: দেলওয়ার হোসেন তার শ্রম ও অর্থের বিনিময়ে ১৯৮৯ সালে স্বপ্নপুরীর কাজ শুরু করেন। বর্তমানে দিনাজপুর-৬ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য মো: শিবলি সাদিক এম. পি’র অধীনে এটি চালু আছে। স্বপ্নপূরী হচ্ছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিনোদন কেন্দ্র।
এখানে রয়েছে দেশী-বিদেশী পশু-পাখির অবিকল ভাষ্কর্য, কৃত্রিম ঝর্ণা, কৃত্রিম চিড়িয়াখানা, জীবন্ত পশু-পাখিদের চিড়িয়াখানা, শিশুদের জন্য পার্ক, দোলনা, ঘোড়ার গাড়ি, হরেক রকম সুগন্ধ ও সৌন্দর্য এবং স্বচ্ছ পানিতে কয়েকটি ফুল বাগান। স্বপ্নপুরীর আরো আকর্ষণ সারি সারি সবুজ দেবদারু গাছের মনোলোভা সৌন্দর্য আর বিস্তীর্ণ ঝিলের তীরে ফুটন্ত গোলাপ বাগানের মাঝখানে স্থাপিত ”নিশিপদ্ম”। দিনাজপুর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা বাসে করে স্বপ্নপুরী যাওয়া যায়। প্রধান শহর থেকে প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। তাই ঢাকা থেকে গেলে এই যাত্রায় সারাদিন লেগে যেতে পারে।
লিচু বাগান
দিনাজপুরের দেশব্যাপী সুখ্যাতি মূলত এর লিচুর জন্যে। এখানকার ১৩টি উপজেলাতেই চাষ হয় লিচুর। লিচুর রাজ্য দিনাজপুর জেলায় ৪ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিধারণ করা হয়েছে। জেলার সব কয়েকটি উপজেলায় দিন-দিন লিচু বাগানের সংখ্যা বেড়েই চলছে। রসালো এই ফল লিচু অনেকের কাছে রসগোল্লা হিসেবে পরিচিত। দিনাজপুর জেলায় মোট ৩ হাজার ১২৮টিরও বেশি লিচু বাগান রয়েছে। এর মধ্যে চিরিরবন্দর থানায় কম করে হলেও রয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ লিচু বাগান।
দিনাজপুর শহরে প্রধান লিচুর বাজার পৌরসভা নিউমার্কেট। প্রতি বছর এখানে লিচু কেনা-বেচা হয়ে থাকে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এখানে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৬০ মোকামে চলে লিচুর বাজার। তাই লিচুর আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে দিনাজপুরে লিচুর মৌসুমে চলে আসেন খুব ভালো লাগবে।
কিভাবে দিনাজপুর যাবেন?
দিনাজপুর যাওয়ার জন্য আপনি সড়কপথে এবং ট্রেন দিয়ে দুইভাবেই যেতে পারেন। ঢাকা থেকে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য উত্তরাসহ গাবতলীর পথে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে বাস পাওয়া যায়। এগুলোর মান ভেদে বিভিন্ন ভাড়া হয়ে থাকে। তারপরে সর্বনিম্ন ৬০০ থেকে ১২০০ টাকায় যেতে পারবেন। এছাড়াও ট্রেনে যাওয়ার জন্য কমলাপুর থেকে সন্ধা ৭.৪০ অথবা সকাল ৯.৫০ মিনিটের টিকিট বুক করা যেতে পারে। এগুলোতে সিটের ধরনভেদে ভাড়া ৩৬৫ থেকে ৯৩০ টাকা।
দিনাজপুরের বিখ্যাত খাবার
‘সিঁদল’ দিনাজপুরের গ্রামবাংলার মুখরোচক খাবার হিসেবে এর কদর রয়েছে যথেষ্ট। সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বাদের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের এটি অতি জনপ্রিয় একটি খাবার। এছাড়া ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কিংবা নিজ বাড়িতে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে একসময় সিঁদল ছিল অন্যতম একটি উপকরণ। লিচু, চিড়া, পাপড়, কাটারিভোগ চাল, সরিষাফুল দিয়ে ডিম ভাজি, রুস্তম হোটেলের কলিজা ও মগজ ভুনা, শচীনদার এক টাকার সিঙ্গারা এবং পাবনা সুইটসের কালোজাম।
FAQS-
# দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত?
=>দিনাজপুর জেলা লিচুর জন্য বিখ্যাত। এ জেলায় বাংলাদেশের সেরা লিচু উৎপন্ন হয়। এ জেলায় বিভিন্ন জাতের লিচু উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মাদ্রাজী, বোম্বাই, বেদানা ও চায়না-৩।
# দিনাজপুরের পূর্ব নাম কি?
=>দিনাজপুর জেলার পূর্ব নাম ছিল ঝিনাইদহ। জেলার আবির্ভাব। শহরটির নাম হয় দিনাজপুর।
# দিনাজপুর বিভাগের নাম কি?
=>দিনাজপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ জেলা।
# দিনাজপুর কত বর্গ কিলোমিটার?
=>দিনাজপুর শহর ২২.৮ বর্গ কি.মি. আয়তনের এলাকাটি দিনাজপুর পৌরসভা দ্বারা পরিচালিত হয়। জনসংখ্যার ভিত্তিতে দিনাজপুর বাংলাদেশের ১৬তম বৃহত্তম শহর।
# দিনাজপুর কত নং সেক্টরের অধীনে ছিল?
=>মহান মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর ৬ ও ৭ নং সেক্টরের অধীনে ছিল।
শেষ কথা
দিনাজপুর বেশ বড় একটি জেলা। দিনাজপুরে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। নিজের শিকড়ের প্রতি মুগ্ধতাই বাঁচিয়ে রাখে কোন জাতিকে এবং তার ইতিহাসকে। দিনাজপুরের ইতিহাস নিজের মুখ দেখছে এই মোখায়। দিনাজপুর জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো থেকে যেকোনো একটিই পরিদর্শন জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর একটি হতে পারে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাকে নিমেষেই নষ্ট করে দিতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত যেকোনো দুর্ঘটনা। তাই ভ্রমণের সময় প্রয়োজন সদা সতর্কতা।
# ভ্রমণ কেনো প্রয়োজন? একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা # আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। কিভাবে স্বপ্নের বাংলাদেশের অভ্যুত্থান হয়?